Sunday, February 25, 2018

ক্রান্তিকাল (কিস্তি ১)

বাজারটার সামনেই প্রায় পঞ্চাশ মানুষের জমায়েত। সবাই লুঙ্গি পরিহিত। আজকালকার যুগে এত মানুষকে একসাথে লুঙ্গি পড়া অবস্থায় দেখা যায় না। অথচ আজ শুক্রবার, বাজার বন্ধ। বাজারের উল্টো পাশে অলস ভঙ্গীতে দোকানি তালা চাবি বিক্রি করার দোকানটা খুলছে। তার ভঙ্গীটা এমন যে সে ভেবেই রেখেছে আজ খদ্দের তেমন আসবে না। তবে পাশের কম্পিউটার দোকানটাই যেন বিরাম নেই। এই সকালেই কিবোর্ডের তাল তুলেছে কম্পিউটারওয়ালা। আর মাঝে মাঝে জড়ো হওয়া লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে নিজের চোখকে বিশ্রাম দেওয়ার চেষ্টা করছে। সাথে একটা ছোটখাটো হোটেল, ডিম ভাজার গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। সেই হোটেল থেকে ব্যাগ হাতে বের হয়ে এল এক যুবক, বোঝাই যায় স্থানীয় নয়। তার কপাল বেয়ে কয়েক ফোটা ঘাম গড়িয়ে পড়তেই ধাক্কা খেল লুঙ্গি পরিহিত এক লোকের সাথে। হাত থেকে পড়ে গেল পঁচিশ হাজার টাকার সোনালী রঙের মোবাইল সেটটা। সাথে সাথেই খিস্তি ঝাড়ল যুবকটা। ঠিক তখনই মিউনিসিপ্যালিটির ট্রাক এসে ডাস্টবিনে জমানো ময়লা নিতে শুরু করল। পচা গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে গেলেও কারো মাঝে ভ্রুক্ষেপ নেই। শুধু একটি ছোট বাচ্চা সকালে হাঁটতে বের হওয়া বাবার পাশে চলতে চলতে প্রশ্ন করে বসল, “বাবা এত গন্ধ কেন?” উত্তরে বাবা শুধু বলল, “হু”। বাচ্চাটা আবার জড়ো হওয়া লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, “বাবা ওরা কে?” এবার বাবা উত্তর দেয়, “রাজমিস্ত্রী”। ছেলেকে আর কোন প্রশ্ন না করতে দিয়েই রিক্সার জন্যে হাঁক মারে। হয়ত হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছেন। ততক্ষণে ধাক্কা খাওয়া যুবক রীতিমত ঝগড়া লাগিয়ে দিয়েছে সেই লুঙ্গি পরিহিত লোকটার সাথে। “সালা, চাষার দল, দেখে চলতে পারিস না?” একটা মেয়ে হোটেল থেকে দ্রুত এসে যুবকটাকে থামায়। নইলে সেই চাষার সাথে হাতাহাতি মারামারি হয়ে যেত তার। এতগুলো চরিত্রের মাঝে কোন চরিত্রই মূল গল্পের কোন চরিত্র নয়। যাকে কেন্দ্র করে এই গল্পের অবতারণা সে এই মুহূর্তে চায়ের দোকানে আরামসে চায়ে চুমুক দিয়ে বসে বসে এইসব দৃশ্য অবলোকন করছে। তার কোন বিষয়েই তেমন কোন তাড়া নেই। হাতে চায়ের কাপটা আজ সকালের তিন নম্বর চা আর সিগারেটটা দুই। যার কথা বলা হচ্ছে তার নাম অনিক। সে প্রতিদিন সকালে এই চায়ের দোকানে এসে বসে থাকে। এইসব দৃশ্য খুব মনোযোগ সহকারে দেখে আর ভাবে মানুষের জীবনে এমন অনেক অদ্ভূত ঘটনা ঘটে যা সিনেমা বা নাটকে ঘটতে দেখলে বিশ্বাস করতে চাইবে না, হেসেই উড়িয়ে দিবে। বেলা হল, তার উঠার সময় হয়েছে, এখন হাঁটার সময়। কড়া রৌদ্রেও হাটাটা আগে কষ্ট লাগলেও এখন বেশ লাগে। রাস্তা পার হয়ে ফুট ওভার ব্রীজে উঠে। বার তের বছরের একটা বাচ্চা ওজন মাপার মেশিন নিয়ে বসে আছে। পাশে লেমেনেটিং করা কাগজে বড় করে লেখা "দুই টাকা"। ছেলেটাকে অনিকের এখানে নতুন মনে হল। প্রতিদিন যাওয়া আসার মাঝে এরকম লোকজন সে খুব মনযোগ সহকারে দেখে। একে আগে দেখেছে মনে হচ্ছে না।
-কিরে, এখানে নতুন নাকি?
ছেলেটা অনিকের দিকে তাকিয়ে থাকে, কিছু বলে না। অনিক আবার জিজ্ঞেস করে,
-কিরে, কথা কইস না ক্যান?
এবার আস্তে আস্তে উত্তর দেয় ছেলেটা,
-নতুন না। বাপে হাসপাতালে।
-তুই রহমতের ছেলে?
মাথা ঝাকিয়ে ছেলেটা জিজ্ঞেস করে,
-ওজন মাপবেন?
-ধুর ব্যাটা, নিয়মিত খাইতে পাই না ওজন মাইপা কি করুম? তোর বাপে হাসপাতালে ক্যান? কিছু হইছে?
আবার কিছুক্ষণ চুপ থেকে ছেলেটা উত্তর দেয়,
-বইন সারারাত বাড়ি ফিরে নাই।
-তাই?
-হ, সকালে ড্রেনের পাশে পাইয়া বাপে হাসপাতালে নিয়া গ্যাছে। মইরা গ্যাছে কিনা জানি না।
অনিক বুঝতে পারল কি ঘটেছে। মনে মনে বলল, হে দুনিয়ার নায়কেরা, সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় তোমরা থাক না কেন?
-চল যাই হাসপাতালে।
-নাহ, বাপে মাইরব।
-আরে চল। আমি তোকে ১০০ টাকা দিবানে, বাপরে দিস, কিছুই আর কইব না।
ছেলেটাকে নিয়ে অনিক যখন হাসপাতালে পৌঁছাল তখন সূর্য ভূমির সমকোণে যাওয়ার চেষ্টা করছে। গেটে ঢুকতেই সিনেমার লোকজন দেখতে পেল ক্যামেরা হাতে। হাসপাতালে শূটিং চলছে। এরা কি মানুষের দুঃখ কষ্ট কিছুই বুঝে না। যেখানে মানুষ মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে আসে সেখানে এমন ভীড় করে শূটিং করা কি ঠিক? অনিক একজনের হাত ধরে ফেলে,
-ভাই, এই ছোট ছেলেটার বোন কাল রাতে রেপড হয়েছে। আপনারা কিছু করুন, আপনারা মিডিয়ার লোক।
-ধুর মিয়া!
এরপর লোকটি হাঁক দেয়, সিকিউরিটি, এই সিকিউরিটি?
অনিক মনে মনে গালি আওড়ায়, সালা হারামজাদা, হারামি, কুত্তার বাচ্চা। একটা চড় মারতে পারলে ভালো লাগত তার। কিন্তু মেয়েটাকে দেখতে যেতে হবে। ফেরার পথে একটা চান্স নেওয়া যেতে পারে।
হাসপাতালের ওয়ার্ডে আসলে সত্যিকারভাবে বুঝা যায়, হয় দেশের জনসংখ্যা বিশালভাবে বেড়েছে নয়ত দেশে হাসপাতালের সংখ্যা অপ্রতুল। কারণ বেডে জায়গা পাওয়া ভাগ্যের কথা আর সরকারী হাসপাতালে তো অমাবস্যার চাঁদ। তার উপর হতদরিদ্রের জায়গা মেলে হাসপাতালের বারান্দায়। রহমত ও তার মেয়ের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটার বাত্যয় ঘটেনি।


Friday, April 27, 2012

এই তো জীবন

২০১০ সালের শেষের দিকে কাজী মামুন বললেন, “তাহমিদের সময় হয়েছে এবার একটি বই বের করার”। একটা পান্ডুলিপি তৈরি করলাম, অনেক কবিতা। মোটে পনেরটা মতন কবিতা নিজের পছন্দ হল যেগুলো দিয়ে বই করা যাবে বলে আমার মনে হল। তাই বাদ দিলাম, বই করা বাতিল। ১৫টা কবিতা দিয়ে তো আর বই হয় না। তবু মাঝে মাঝে এসে হুংকার দিলাম, “আমার বই বের হচ্ছে, আমার বই বের হচ্ছে”। কিন্তু বই বের করলাম না। ২০১১ সাল গেল, ২০১২ সাল এল। আবার শুরু হল, বই বের করা হোক, বই বের করা হোক। এবার প্রথম কথায় নাকচ। যখন সবাই নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে নিজের বই বের করছে তখন আমার কাছে কবিতা স্টল ৩ বের করাই শ্রেয় মনে হয়েছে। সেদিন আমার কিছু কবিতা পড়তে পড়তে সুবীরদা বললেন, “আপনার কাব্যগ্রন্থ নেই”? আমি বললাম, “না নেই”। তিনি আবার বললেন, “এবার মনে হয়...”। আমি হাসলাম। মনস্থির করেছি, সামনে বছর না, পরের বছরও না। তবু রানা ভাইয়ের সাথে দেখা হওয়ার পর অভিযোগ করলেন, “তাহমিদ তো বই বের করার জন্যে পাগল”। এই চান্সে মিয়াজী ভাই বললেন, “পিয়াস মজিদ আমার বিশেষ পরিচিত, আমি বললেই বই বের হয়ে যাবে, করবেন?” এর উত্তর রানা ভাই আমাকে দিতে দেননি সেদিন। কিন্তু এখন নিচের লেখাটি পড়াতে তো সমস্যা নেই।

http://rongon1971.blogspot.com/2012/03/blog-post_4820.html#!/2012/03/blog-post_204.html

কবিতা স্টল বের করার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, আমার মত যারা তরুণ, ভাল লিখছে তাদের লেখা প্রকাশ করা। আমি নিজে চেয়ে সেই লেখা ছেপেছি। আমার মনে হয়েছে অসংখ্য প্রতিভাবান তরুণ আমাদের আছে যারা অল্প কিছু পরিচর্যা পেলে একদিন ঠিকই নতুন জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথ হতে পারবে। আমি নিজে তরুণ তাই হয়ত তরুণদের ভাল বুঝতে পারি।

আমি একদিক দিয়ে ভাগ্যবান। বহু উপদেশ এ জীবনে পেয়েছি। যার সাথেই পরিচয় গাঢ় হয়েছে, তাদের ভালবাসাতেই সিক্ত হয়েছি আমি। কিন্তু যে উপদেশটা আমি কখনো পাত্তা দেইনি সেটা হচ্ছে, “ওর কাছ থেকে দূরে থাক, ওর সাথে মিশিও না”। আমি বলি, “একটা সজারুর কাছে থেকেও অনেক কিছু জানার আছে, আর এ তো মানুষ”। আমি যেটা জেনেছি, বিশ্বাস করি সেটা হচ্ছে, সবার কাছ থেকে ভাল জিনিস গ্রহণ করা। এ জিনিসটা অনেকে বুঝে না। ধরেন, একজন মানুষ অনেকের কাছে অপাংক্তেয়। কিন্তু আমি ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করেছি। এর মানে এই নয় যে, আমিও অপাংক্তেয় হয়ে যাব। নিশ্চয় আমি কিছু একটা ভাল জিনিস দেখেছি, সেটা আমার ভাল লেগেছে, আমি কথা বলেছি, এতে সমস্যার কি আমি বুঝি না। রানা ভাই যেমন টিটকারী করে বলে, “তোমার পাঠক তো উমুক”।

কাজীদার সাথে অনেকদিন সাহিত্য সাহিত্য যুদ্ধা খেলা হয় না। মানুষটা কয় থাকে বুঝিনা। রুবিনা আপু একদিন বললেন, “তোমার আর কাজী মামুনের মধ্যে এইজন্যেই এত মিল”। কিন্তু আমার তো শুধু অমিলের কথায় মনে পড়ে। তবে হ্যাঁ একমাত্র এই মানুষটার কথায় আমি মনেহয় অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করি। সত্যি কথা বলতে কি তিনি নিজে একজন কবি অথচ তার লেখা আমাকে পড়তে দিয়েছেন খুবই কম। অনলাইনে তার লেখা হঠাৎ হঠাৎ দেখা যায়। আর অন্যদিকে নিজের সহপাঠী মনে করি যাকে, হাসান সুমন, তার লেখা পড়লে হীনমন্যতায় ভুগি। যারা বয়সে একটু বড় তাদের অনেকেই বয়সে একটু যারা ছোট তাদের অনেকের লেখা পড়ে একধরনের হীনমন্যতায় ভুগেন। আমার মধ্যে তা নেই কিন্তু কবি হাসান সুমনের কবিতা পড়লে হীনমন্যতায় ভুগি। তার কবিতা পড়লেই মনে হয়, “ব্যাটা দাড়া এইবার এমন একটা মাস্টারপিস লিখুম না, সবার চোখ ত্যাড়া কইরা দিমু”। এরকম সিচুয়েশনে লেখা আমার কবিতা পড়ে অনেকেরই ভাল লেগেছে।

২০০৯ সালের দিকে একটা ঘটনা মনে পড়ছে। তখন কতগুলো বাংলা ফোরামে লিখতাম। প্রজন্ম ডট কম, রংমহল ডট কম। রংমহলে আমার কবিতার একটা সংকলনও আছে মনে হয়। এখানে পোংতা লিরিক্স নামে একজন ছিল যে প্রত্যহ আমার নতুন কবিতায় কমেন্ট করে যেত যেগুলো পড়লে খুব ভাল লাগত। তখন একটুখানি সমালোচনার খুব অভাব ছিল। ফলে তার কমেন্ট পাওয়া নিয়মিত হয়ে গেল। অনেকদিন তার ভাল নাম আমি জানতে পারিনি। এর তার কাছে অনেক পরে জানতে পারি তার নাম। সেই থেকে পরিচয় কবি ফয়সল অভির সাথে।

আরেকজন মানুষের কথা বলি। কেউ যদি বলে, বিশটা টাকা দাও তো, আলু কিনব। এমন লোক সাধারনত আমরা এড়িয়েই চলব। কিন্তু আমি এড়িয়ে চলি না। না দিতে পারলে বলি, দিতে পারব না। উনার সাথে কিভাবে পরিচয় এখন আর মনে নেই। তার কবিতা আমার ভাল লাগে। তাতেই তো হল, অন্য কিছু নিয়ে এত ভাবি না। সে লোকটা সরসিজ আলীম। পাতাটি যতই মেজাজ দেখাক, লোকটা বেঁচে থাক।

আরেকটা নাম মনে আসছে ত্রিশাখ জলদাস। প্রথম পরিচয় যখন দাদা ডাকলাম তখন মনে হয় রেগেই গিয়েছিলেন। আমাকে বলেছিলেন, “জান তোমার বয়েসি আমার একটা ছেলে আছে”। আমি তখন বুঝি নাই পরে মনে হল এইজন্যেই হয়ত বলেছিলেন। একবার একটা গ্রুপে বাংলাদেশ নিয়ে কলকাতার কেউ কটু বাক্য বলায় তিনি এমন ক্ষেপেছিলেন তা দেখার মত। লোকটাকে ক্ষমা না চাইয়ে তবে ক্ষান্ত দিয়েছিলেন।

অরণ্যক টিটোদার কথা না বললেই নয়। আমার কবিতা নিয়ে তার মত প্রশংসা খুব কম জনেই করেছে। কবিতা স্টল বের করার পর তার সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা সাহিত্যালাপ হয়েছে। তাকে একবার মজা করে বলেছিলাম, “আমার বউয়ের পর আপনার সাথেই হয়ত এত দীর্ঘ সময় ধরে কথা বললাম”। আমার খুব ইচ্ছে চিটাগাং যাই এবং তার সাথে একটা সন্ধ্যা সামনা সামনি আড্ডা দেই।

অন্য প্রসংগে যাই, কিছুদিন আগে একজনকে রক্ত দান করলাম। প্রথম অভিজ্ঞতা। নাজলা আপু ফোন দিয়ে বললেন, “রক্ত দিতে পারবা কিনা?” আমি ক্ষীন স্বরে বললাম, “পারব”। গলার সাহস নেই কারণ আমি হাসপাতাল খুব ভয় পাই। সত্যি বলছি। অপরিচিত কেউ হলে এড়িয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু নাজলা আপু বললেন, “যাবা কিন্তু নাহলে দেখা হলে মাইর খাবা”। গাপুস গুপুস নাজলা আপা যদি আমারে মাইর দেয় তাহলে আমার একটা হাড়ও আস্ত থাকবে না বলে মনে হল। এই ভয়েই হয়ত রক্ত দিয়ে এলাম। রক্ত দিয়ে কেন জানি না মনটা খুব ভাল হয়ে গেল। গর্বে বুকটা ভরে গেল। এ অনুভূতিটা তো দরকার ছিল! এর বিনিময় নাজলা আপুর প্রেমের উপন্যাসটা কিনাই যায়। :P

দুইদিন ধরে বউয়ের সাথে মন কষাকষি চলল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জয়টা সবসময় আমারই হয়। এই সুখবোধ নিয়ে এখন বলছি, আহা জীবন! অথচ কয়েকদিন আগেও......। তাই এই তো জীবন।